প্রযুক্তি ও বিশ্বায়ন বনাম পৃথিবীর অস্তিত্ব

বিশ্বব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন “Reboot Development: The Economics of a Livable Planet” নতুন করে চিন্তায় ফেলেছে বিশ্ববাসীকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রযুক্তির অগ্রগতি ও শিল্পায়নের যুগে মানুষ যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি ধীরে ধীরে নষ্ট হচ্ছে সেই পৃথিবীই, যার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে সমগ্র মানবসভ্যতা।

পরিবেশ

নিতীশ কুমার মণ্ডল

10/18/20251 min read

বিশ্বব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন “Reboot Development: The Economics of a Livable Planet” নতুন করে চিন্তায় ফেলেছে বিশ্ববাসীকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রযুক্তির অগ্রগতি ও শিল্পায়নের যুগে মানুষ যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি ধীরে ধীরে নষ্ট হচ্ছে সেই পৃথিবীই, যার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে মানবসভ্যতা।

বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের একটি দলের তইরি এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওার পর ঘুম উড়েছে মানুষের। এর মূল বক্তব্য হল—অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি টেকসই বা সুস্থায়ী (sustainable) না হয়, তবে সেই উন্নয়ন নিজেই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে মানবজাতিকে।

রিপোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ এমন অঞ্চলে বসবাস করছে যেখানে ভূমিক্ষয়, বায়ু দূষণ বা জলসংকটের মতো এক বা একাধিক পরিবেশগত সমস্যা রয়েছে। নিম্নআয়ের দেশগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ—সেখানে ৮০ শতাংশ মানুষ একসাথে তিনটি পরিবেশগত ঝুঁকির মুখোমুখি:

  • দূষিত বাতাস

  • অনিরাপদ পানীয় জল

  • অবক্ষয়িত ভূমি

অন্যদিকে, উচ্চআয়ের দেশগুলিতে ৪৩ শতাংশ মানুষ এই তিনটি বিপদ থেকে মুক্ত, যা বিশ্বব্যাপী বৈষম্যের এক ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরে।

বিশ্বব্যাংকের এই গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের ক্রমবর্ধমান ভোগবাদ ও শিল্পায়নের ফলে আজ পৃথিবীর মোট স্তন্যপায়ী প্রাণীর জৈবভরের (biomass) প্রায় ৯৫ শতাংশ দখল করেছে মানুষ ও গৃহপালিত প্রাণী। যেখানে বন্য প্রাণীরা রয়ে গেছে মাত্র ৫ শতাংশ। যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে মানুষের প্রভাব এখন পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্যকেই বদলে দিচ্ছে। এছাড়াও, পৃথিবী ইতিমধ্যে “Planetary Boundaries” নামে পরিচিত নয়টি পরিবেশগত সীমার মধ্যে ছয়টি সীমা অতিক্রম করেছে—যেমন জলসম্পদ ব্যবহার, ভূমির পরিবর্তন, নাইট্রোজেন দূষণ, জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়, রাসায়নিক দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন।

অন্যদিকে, প্রতিবেদনে বনভূমির অর্থনৈতিক মূল্য নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অরণ্য শুধু কার্বন শোষণ বা জীববৈচিত্র্যের আশ্রয় নয়, বরং তা বৃষ্টিপাতের উৎস এবং কৃষির জন্য অপরিহার্য আর্দ্রতার জোগানদার। গবেষণায় উঠে এসেছে—প্রাকৃতিক অরণ্য ধ্বংসের কারণে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী কৃষিখাতে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩৭৯ বিলিয়ন ডলার, যা সমগ্র বিশ্বের কৃষিজাত মোট আয়ের ৮ শতাংশ। এছাড়া, বনভূমি খরার সময় প্রাকৃতিক সুরক্ষার কাজও করে। নির্বিচারে বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে তাপমাত্রা যেমন দিনদিন বাড়ছে তেমনই বাড়ছে খরার হার। গবেষণায় দেখান হয়েছে, প্রাকৃতিক বন থাকা এলাকায় খরার সময় জিডিপি হ্রাসের হার অর্ধেকেরও কম থাকে।

নাইট্রোজেন সার আধুনিক কৃষির বিপ্লব ঘটালেও অতিরিক্ত ব্যবহারে তা আজ বিষে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—
বিশ্বের অর্ধেক খাদ্য এমন অঞ্চলে উৎপন্ন হয় যেখানে নাইট্রোজেনের অতিরিক্ত ব্যবহার লাভের পরিবর্তে বরং ফলনের ক্ষতি করছে এবং এর ফলে প্রতিবছর বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতি বছর অন্তত ৫.৭ মিলিয়ন মানুষ মারা যাচ্ছে বায়ু দূষণের কারণে—যা তামাক, যুদ্ধ বা অপুষ্টির থেকেও বেশি প্রাণহানি ঘটায়। দূষিত বাতাস শুধু রোগই বাড়ায় না, কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতাও কমিয়ে দেয়। তবে, রিপোর্টে সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত ও উঠে এসেছে। আশার কথা—চীনের “War on Pollution” দেখিয়েছে যে, কঠোর নীতি ও প্রযুক্তির সাহায্যে দূষণ কমানো সম্ভব। এক দশকের মধ্যে দেশটির অনেক শহরেই বায়ুর মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রকৃতি-নির্ভর উন্নয়নে বিনিয়োগ কাজের সুযোগও বৃদ্ধি করবে। গবেষণায় দেখা গেছে—কম দূষণকারী শিল্পখাতে প্রতি ১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে ১৪টি চাকরি তৈরি হয়, যেখানে দূষণকারী খাতে তা মাত্র ৬টি।

রিপোর্টের মূল বার্তা একটাই—“উন্নয়ন আর পরিবেশ বিপরীত নয় বরং একে অপরের পরিপূরক। প্রকৃতিকে রক্ষা করলেই অর্থনীতি বাঁচবে, কর্মসংস্থান বাড়বে, এবং ভবিষ্যৎ হবে টেকসই।” বিশ্বব্যাংক বলছে, এখনই সময় “সিস্টেমকে বদলানোর”। যা সম্ভব হবে- তথ্য ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সঠিক নীতি প্রণয়ন, আন্তঃখাত সমন্বিত পরিবেশনীতি বাস্তবায়ন, এবং নিয়মিত মূল্যায়নের মাধ্যমে কার্যকারিতা যাচাই করলে। কিন্তু আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা কি আদৌ সচেতন, তাঁরা কি পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত? সন্দেহ আছে!!!

একটি “বসবাসযোগ্য পৃথিবী” (Livable Planet) গড়ে তোলাই হবে আগামী শতকের অর্থনৈতিক সাফল্যের আসল পরিমাপ।

📖 সূত্র: World Bank (2025), Reboot Development: The Economics of a Livable Planet
লেখকগণ – রিচার্ড দামানিয়া, এবাদ এবাদি, কেনতারো মায়র, জেসন রাস ও ইশা জাভেরি।